মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:১৯ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

স্বাধীনতার পঞ্চাশে হোক নতুন যাত্রা

তুষার আবদুল্লাহ:

রিমোট দিয়ে টিভিকে বোবা করে দেই। কারণ যে শব্দগুলো টিভিতে উচ্চারিত হচ্ছিল নিয়মিত, তা সইতে পারছিলাম না। বোবা করে দিয়ে যিনি কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন, তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কী অদ্ভুত, শব্দ নেই, কিন্তু তার শারীরিক ভাষাতেই যেন ফুটছে শব্দগুলো। আমি সেই দৃশ্যও সইতে পারছিলাম না। চ্যানেল বদল বা টিভি বন্ধ করে দেইনি, নিজে এক-দুই মিনিট অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতাম। আর নিজের কাছেই প্রশ্ন রেখেছি, স্বাধীনতার এই পঞ্চাশ বছরে এসে আমরা কত পিছিয়ে গেলাম? এতটাই পিছিয়েছি যে, তার কথা সইবার শক্তি ও যোগ্যতা হারিয়েছি। তাকে রেখেছি পোশাকের সম্মুখে, বচনের প্রান্তে, কিন্তু রাখিনি হৃদয়ে এবং মস্তিষ্কে।

একাত্তরের ৭ মার্চ থেকেই যদি শুরু করি, সেই ভাষণ একটি জাতিকে মুক্তিসংগ্রামে সমাবেত করল। জনযুদ্ধে ঝাঁপ দিলেন সকল শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ। তিনি ফিরলেন, স্বাধীন রাষ্ট্রে। গড়তে শুরু করলেন একটি নতুন দেশ। কিন্তু দেখা গেল তিনি পূর্ব বাংলার মানুষদের নিয়ে যে সোনার বাংলা তৈরি করতে চাচ্ছেন, সেই সোনা, লুটপাটে নেমে পড়েছে তার আশপাশের মানুষেরাই। সঙ্গে ছিল দেশের বাইরের শত্রুতা। তখন যারা দুর্নীতি করছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বারবার। আহ্বান জানিয়েছেন দেশ সেবায় আত্মনিয়োগের।

সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশকে অস্থির করে তুলছিল একটি পক্ষ। শত্রুদের পাশাপাশি দলীয় ও নিকটজনের ছদ্মবেশে থাকা শত্রুও। সেই সময় তার বক্তব্য টেলিভিশনে প্রচার করা হয়। আমি সেই বক্তব্য শুনে ভাবি আমরাতো সেই একই সময়ের ঘূর্ণিতে আছি।

সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশকে অস্থির করে তুলছিল একটি পক্ষ। শত্রুদের পাশাপাশি দলীয় ও নিকটজনের ছদ্মবেশে থাকা শত্রুও। সেই সময় তার বক্তব্য টেলিভিশনে প্রচার করা হয়। আমি সেই বক্তব্য শুনে ভাবি আমরাতো সেই একই সময়ের ঘূর্ণিতে আছি। এখনও দেশে দুর্নীতিই সত্য। নীতি উপেক্ষিত। দেশ গড়া নয়, নিজেকে গড়ার যুদ্ধে নেমেছি সবাই। বেপরোয়া হয়ে গেছি লুটপাটে। দেশকে ভালোবাসতে পারছি না, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্বদেশ দরকার বা যেন অনিবার্য হয়ে পড়েছে এই পঞ্চাশ বছরে। সম্পদ, টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি সেই দ্বিতীয় এবং তৃতীয়তে। লজ্জা ও আত্মঘৃণায় তার সেই উচ্চারণ কানে তুলতে পারছি না।

যুদ্ধোত্তর কোনো দেশের জন্য ফুল বিছানো পথ অপেক্ষা করে না। বরং সেই পথ কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুদ্ধ ক্ষেত্রের চেয়ে বেশি কণ্টকাকীর্ণ থাকে। তিনি দেশ গড়বেন না কাঁটা বাছবেন। দলের কর্মী ও পাশের নেতা বা সহযোদ্ধা যখন কাঁটা হয়ে ওঠেন, তখন লড়াইটা হয়ে ওঠে জীবনবাজির। তিনি তাই করলেন, হারালেন জীবন। তারপর তাকে হত্যার পর শুরু হলো ইতিহাস বিকৃতি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক তিনি থাকতেই শুরু হয়েছিল, তবে তিনি চলে যাওয়ার পর আরও মিথ্যা উপকরণ যোগ হতে থাকে। এটি ষড়যন্ত্রেরই অংশ।

বিতর্ক তৈরি করার মাধ্যমে জাতিকে দ্বিখণ্ডিত বা খণ্ড খণ্ড করা হলো। ষড়যন্ত্রকারীরা সফল। এক সময় দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির বাইরে একটি বিরোধী পক্ষ ছিল। তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে ঠিক, কিন্তু এখন মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর গোত্র তৈরি হয়েছে, স্বাধীনতার সপক্ষের দলের মধ্যে গোত্র তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতার সপক্ষের দলটি দেড় দশক ক্ষমতায়, এই সুযোগে ক্ষমতার স্বাদ নিতে বিরোধীরাও ওই দলের কর্মী, নেতা। তাদের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর নাম আরও দরাজ ভাবে উচ্চারিত হয়। বিনিময়ে লুটপাট দুর্নীতির ইজারা তারা নিয়ে নিয়েছে।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির প্রকৃত যোদ্ধাদের তারা বিপক্ষের শিবিরের বলে প্রোপাগান্ডা চালাতে শুরু করেছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের অবুঝ একটি অংশের হয়তো সায়ও আছে। কিন্তু এর ফলাফল কী? এর ফলাফল হলো বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার মানুষ যে অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যের বাংলাদেশ চেয়েছিল, সেই গন্তব্য থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি ক্রমে ক্রমে।

আয়োজন কম নয়। দৃশ্যমান উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি বেশ। সেই উন্নয়নে জনগণ কতটা উপকারভোগী হচ্ছে, নিজেকে এই উন্নয়নের ভাগীদার মনে করে কি না। উন্নয়নের যে বণ্টন, সেখানে কতটা সাম্য আছে। উন্নয়নের মাঝে সুখ ও প্রশান্তির পরশ আছে কতটা? উন্নয়ন উপভোগে যদি বিভক্তি থাকে, বৈষম্য থাকে, তাহলে সেই উন্নয়নকে জনমুখী বা জনমনস্ক উন্নয়ন বলা যাবে না। একই সঙ্গে উন্নয়নের রূপরেখায় থাকতে হবে শৃঙ্খলা এবং সমন্বয়। সেইখানে ঘাটতিতো রয়েই গেছে।

দেশকে ভালো না বাসলে উন্নয়ন উপভোগ করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে ফিরে যেতে হবে আবারো একাত্তরের কাছে। যেমন করে এই বাংলাকে ভালোবেসেছিলেন বঙ্গবন্ধু…

শুধু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিকে তাকালেই স্পষ্ট বোঝা যাবে। সময়ে সময়ে আমরা শিক্ষার ধরন, নীতি, পাঠ্যক্রম বদলে দিচ্ছি। বদলাচ্ছি পরীক্ষা পদ্ধতি। অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষা। রকমারি শিক্ষার ধারা চলছে। একমুখী শিক্ষায় যেতে পারিনি। শিক্ষার মস্তিষ্কে উপনিবেশের প্রভুক্ত রয়েই গেছে। এর প্রভাব বাড়ছে, তাই শিক্ষায় সরকারের নানা রকম প্রণোদনার পরেও বৈষম্য বাড়ছে।

স্বাস্থ্যের দুর্বল ও দুর্নীতিযুক্ত কাঠামোর কথা আমরা জানতামই। করোনাকালে পরিচয় হলো আরও খোলামেলাভাবে। বিশৃঙ্খলা রয়েছে আর্থিক খাতেও। রাজনীতি চলে যাচ্ছে বণিকদের দখলে। রাজনীতির গণতান্ত্রিক ও শুদ্ধ অনুশীলন নেই। বরং রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিরোধ ও দূরত্ব বাড়ছে। এসব কিছুর জন্যই দায়ী করতে হয় আদরের ঘাটতিকে। এই ঘাটতি দেশপ্রেমের।

দেশকে ভালো না বাসলে উন্নয়ন উপভোগ করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে ফিরে যেতে হবে আবারো একাত্তরের কাছে। যেমন করে এই বাংলাকে ভালোবেসেছিলেন বঙ্গবন্ধু, জনযুদ্ধে অংশ নেওয়া মানুষেরা, ঠিক তাদের মতো করেই ভালোবাসতে হবে দেশকে, দেশের মানুষকে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে আবারো আমাদের সেই শপথ নিতে হবে। না হলে বিরোধ, বৈষম্য বাড়বেই। স্বাধীনতার পঞ্চাশে শুরু হোক নতুন বাংলাদেশের যাত্রা।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION